Tuesday, May 2, 2017

ভিন্ন পেশার এই মানুষগুলোকে একটা বৃত্তে আবদ্ধ করেছে যান্ত্রিক সাইকেল স্কুটি।

ও রে হাওয়ার উপর চলে গাড়ি, লাগে না পেট্রোল ডিজেল, মানুষ একটা দুই চাকার সাইকেল। হ্যাঁ মানুষ নামের সাইকেলে পেট্রোল ডিজেল না লাগলেও খুকুমনি, নিলুফা ইয়াসমিন শিলা, সোনিয়া লায়লা, মাহিনুর আক্তার, সাকিয়া হক, মানশি সাহা, মুক্তা, সুমা, নিপার দুই চাকার যান্ত্রিক সাইকেল স্কুটিতে পেট্রোল লাগে।


স্বপ্নচারিনী সদস্যদের আড্ডাবাজি, সংসদ চত্ত্বর

ঢাকার জীবনযাত্রায় একটা যান্ত্রিক সাইকেল নারীর জীবনে কতটা গতি আর স্বাধীনতা এনে দিয়েছে তারই গল্প শুনছিলাম সংসদ ভবন চত্ত্বরে। ফেইসবুকে স্বপ্নচারিনী নামের নারী স্কুটি চালকদের একটা ক্লোজগ্রুপ আছে তাদের। পেশায় তারা কেউ উন্নয়নকর্মী, কেউ হিসাবরক্ষক, কেউ ব্যবস্থাপক, কেউবা শখের ভ্রমণকারী। ভিন্ন পেশায় নিয়োজিত তারা, শহরের ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তে তাদের অবস্থান। কাজের প্রয়োজনে ছুটতে হয় তাদের শহরে এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। আর এই ছুটাছুটিকে সহজ করে দিয়েছে স্কুটি।
গণ পরিবহনে রাষ্ট্র নয় সিট বরাদ্দ দিয়ে তার দায় দায়িত্ব শেষ করে ফেলেছে। পিক আওয়ারে তো নয় সিটের পর আর কোন নারীকে গাড়িতে তোলা হয় না সিট নেই, সিট নেই বলে। পিক আওয়ারে ঢাকায় নারীর যাত্রায় যে কতটা কষ্টকর তা শুধুই ভোক্তভোগী নারীরা জানে।
তবে স্কুটি চালক নারীরা এখন ঢাকায় চলাচলে অনেকটাই স্বাধীন। অফিস থেকে ফেরা পথে এখন আর বাসের ৯সিটের পিছনে ছুটতে হয় না। বাসের সিট না থাকলেও তাদের পিছনের সিটে সহকর্মীরা স্থান পায়।



নিলুফা ইয়াসমিন শিলা, কাজের প্রয়োজনের আর ঘুরাঘুরি।ঢাকায় স্কুটির বিকল্প স্কুটিই।

নিলুফা ইয়াসমিন শিলা, Nilufa Yesmin Shila কর্মরত আছেন, আগোরা’য় পাশের দেশের তুলনায় স্কুটির দামটা অনেক বেশি। রাস্তায় কোন নারী স্কুটি চালক দেখলেই আমাদের বন্ধুত্ব হয়ে যায়। এভাবেই আমাদের মাঝে নেটওর্য়াক তৈরি হচ্ছে। শহরে এখন নারী স্কুটি চালকের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। যাতায়াতের ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে যাদের একটু সামর্থ্য আছে তারাই স্কুটি কিনছে।
যারা একটু দক্ষ তাদের দায় দায়িত্ব যেন একটু বেশি। কারো স্কুটি বিষয়ক কোন সমস্যা হলে ফোন আসে। যেমন খুকুমনি Khuku Moni দুই চাকার যান্ত্রিক সাইকেল চালানোর তার অভিজ্ঞতা প্রায় ১৫ বছর। আর তাই তার কাছে ফোন আসে সবচেয়ে বেশি। নতুনরা ফোন দিয়ে আপা গাড়ি র্স্টাট হচ্ছে না, ইঞ্জিন গরম হয়ে যাচ্ছে বেশি, ইঞ্চিন ওয়েল কত কিলোমিটার চলার পর পরিবর্তন করব, কোথায় সার্ভিসিংয়ের জন্য ভাল। অভিজ্ঞতা থেকে হাসিমুখে খুকুমনি উত্তর দিয়ে যান।



খুকুমনি প্রায় ১৫ বছর যাবৎ ঢাকায় রাস্তায় যান্ত্রিক সাইকেল চালান তিনি

খুকুমনি বলেন, আমি যখন স্কুটি কিনেছি তখন ঢাকায় গুটা ১০ নারী স্কুটি চালক ছিল না। ঐ সময় রাস্তায় সবাই অবাক হয়ে দেখত। তখন গাড়ির কোন সমস্যা হলে কারো সাথে আলোচনা করব তার ব্যবস্থা ছিল না। এখন তো আমাদের বিশাল নেটওর্য়াক। নিমিষেই সবকিছুর উত্তর পাওয়া যায়।
আমরা সুযোগ পেলেই ঘুরতে বের হয়ে পড়ি। আমাদেরও কাছে ঘুরাঘুরি মানেই দিন তিনেকের জন্য সিলেট,চট্টগ্রাম, খুলনা নয়। আমরা ঢাকায় কিংবা ঢাকার আশে পাশে এলাকাগুলোতে ঘুরি ফিরি। কয়েকদিন আগে ঘুরে আসলাম মৈনটঘাট। সকাল নয়টায় রওনা হয়ে মৈনটঘাট ঘুরে চলে আসলাম দুপুর তিনটায়। সকাল ৯ টায় আমরা ১০ জনের দল রওনা হলাম। তারপর সারাদিন ঘুরে ফিরে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরা।
Mahinur Aktar মাহিনুর আক্তার নিপা ভ্রমণ তার শখ নেশা যাই বলা হোক না কেন কোন আপত্তি নেই। নিজের পরিচয় ভ্রমনকারী হিসেবে দিতেই বেশি পছন্দ করেন। দেহকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য খাদ্য দরকার হয়। কিন্তু মনের? মনকে তো সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। জীবন মানেই শুধুই সময় পার করা নয়। সময় তো খাচাঁয় বন্দী পশু-পাখিও পার করে। আমরা জীবন উপভোগ করতে চাই। তাই যখনই সময় পাই আমরা ছুটে যাই। আমরা ছুটে যাই জীবন উপভোগ করব বলে রুহিতপুর, জাহাঙ্গীর নগর, বিরুলিয়া, মৈনটঘাট, বৈদ্যবাজার, চুনারচর, ওয়াসপুর, পুরান ঢাকা। ঘন্টায় ৩০ থেকে ৪০ গতিতে গাড়ি চালাই আমরা কারণ এই গতিটা নিরাপদ এবং জ্বালানী সাশ্রয়ী। আমাদের দলের হেলমেট পড়া এবং ট্রাফিক আইনমানা বাধ্যতামূলক। আমরা রাস্তায় পথচারীদের সম্মান করে চলি। তাই কখনোই ফুটপাতে স্কুটিটি তুলে দেই না।
ঢাকায় এখন অনেক গ্রুপ আছে নারী স্কুটি চালকদের। এই গ্রুপগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বেশ তৎপর। নারী স্কুটি চালকদের গ্রুপগুলো বেশির ভাগ ক্লোজগ্রুপ। সপ্তাহে বা মাসে কোন কোন দিন তারা ঘুরতে বের হয়ে যায় দলবেধে। তেমনি একটি গ্রুপ ট্রাভেলেটস্ অব বাংলাদেশ। ফেইসবুকে তাদের শুধুমাত্র নারী সদস্য সংখ্যা ৮ হাজার। ২০১৮ সালে এপ্রিল মাসে ৬৪টি জেলা ভ্রমণ করবে তারা। ইতিমধ্যে নারী চোখে বাংলাদেশ নামে তারা সারাদেশ ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছে। ঢাকার কেন্দ্রিয় শহীদ মিনার থেকে গত ৬ এপ্রিল রওনা দিয়ে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত চারজনের দল ঘুরে আসে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, নরসিংদি জেলা।
কেমন ছিল সেই ভ্রমন? কথা হয়েছিল সেই দলের নারী ভ্রমণকারী নাজমুন নাহার মুক্তা ও শামছুর নাহার সুমার সাথে। একজন ইডেন কলেজে অন্যজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। আমরা শুধুই ঘুরতে চাই না। ঘুরাঘুরি ছাড়াও আমরা চাই সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে বিভিন্ন সামাজিক কাজে এগিয়ে আসতে।
তাই নারী চোখে বাংলাদেশ ভ্রমণে আমরা যেখানে গিয়েছি সেখানে বিভিন্ন স্কুল-কলেজে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, নারী ক্ষমতায়, পরিচ্ছন্নতা বিয়ষক প্রচারণা চালিয়েছি। আমাদের দলের সাকিয়া হক ও মানসি সাহা তুলি দুজনই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পড়ে। তারা বর্তমানে মালেশিয়াতে আছেন। তারা ঢাকায় ফিওে আবারও শুরু করবে যাত্রা “নারীর চোখে বাংলাদেশ” ভ্রমনের ।



সোনিয়া লায়লা, প্রায় ১বছর যাবৎ স্কুটি চালাচ্ছেন।

সোনিয়া লায়লা Sonia Laila উন্নয়নকর্মী, মাত্র কয়েক মাসহল স্কুটি চালাচ্ছেন। নানা সীমাবদ্ধতার মাঝে তার নিজের একটা স্কুটি আছে তাতে গর্ববোধ করেন। পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে সকাল বিকাল রাত যখনই দরকার তখনই আমরা ছুটতে পারি।
ধরুন অফিস থেকে ফেরা পথে আমরা মিনিট তিরিশের জন্য এক হয়ে গোটা বিশ ত্রিশ টাকার বাদাম চিবুই। এটাই আমাদের বিনোদন। সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে বাসায় ফিরি উৎফুল্ল মন নিয়ে। এক ফ্ল্যাটের মানুষ যখন একজন আর একজনকে চিনে না তখন আমরা দলবেধে ঘুরতে বের হই। কংক্রিটের শহরে জীবন মানেই আমি আর তুমিতে শেষ হয়ে যাচ্ছে। সেখানে আমরা দুই চাকার সাইকেল স্কুটিকে কেন্দ্র করে শহরের অনেক নারী ঐক্যবদ্ধ হচ্ছি। একে অপরের সমস্যা এগিয়ে আসি।

ক্লান্তি আর ব্যস্ততার পরও শহরের খুকু,সোনিয়া, নিপার মত নারীদের সেতুবন্ধনের নাম স্কুটি। ভিন্ন পেশার এই মানুষগুলোকে একটা বৃত্তে আবদ্ধ করেছে যান্ত্রিক সাইকেল স্কুটি।




অফিস থেকে ফেরার পথে চলছে আড্ডা।সংসদ ভবন চত্ত্বর, ঢাকা।

No comments:

Post a Comment