Tuesday, May 2, 2017

ওস্তাদ নাজমা আক্তার। পেশায় রিকশা মিস্ত্রি।

ঢাকার রিকশা, ঢাকার গন্ডি পেরিয়ে স্থান করে নিয়েছে গ্রিনেস ওয়ার্ল্ড বুকে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি রিকশা চলাচল করে ঢাকায়। সংখ্যা তার ৫ লক্ষের বেশি। ঢাকার রিকশা এখন এই শহরের কোটি মানুষের চলাচলের মাধ্যম। এই পরিবেশবান্ধব যানটার নিয়ে নানা অযৌক্তি, অবৈজ্ঞানিক ধারনা প্রচলিত আছে। বলা হয় রিকশা ঢাকার যানজটের অন্যতম কারণ। কিন্তু নগরবিদ এবং পরিবহন পরিকল্পনাবিদরা এখন একমত যে এই ধারনাটি ভুল এবং মনগড়া। আর এই ভুল ধারণার ভিত্তি করে রিকশা উচ্ছেদের সিদ্ধান্তটাও ছিল ভুল।
রিকশা নিয়ে এক বৃট্রিশ নগর পরিকল্পনাবিদ রব গ্যালাগার, রিকশা অব বাংলাদেশ নামে হাজার পৃষ্ঠার বই লিখে ফেলেছেন। রিকশা নিয়ে এমন হাজার পৃষ্ঠার বইয়ের পাশাপাশি হাজার হাজার গল্প করা যাবে। তবে আজ যে গল্প শুনাতে চাই তাহল নাজমা আক্তার।

রিকশা মেরামতে ব্যস্ত নাজমা আক্তার।
ঢাকায় রিকশার সাথে জড়িত সকল পেশাই মূলত পুরুষের দখলে। আর তাই যদি আমার মত আপনার ধারনা হয়ে থাকে। তবে পরিচয় হোন নাজমা আক্তারের সাথে । নাজমা আক্তার বয়স ৪৫। জন্ম ঢাকায়। গ্রামের বাড়ি বরিশালের মাঠবাড়িয়া। প্রায় ৩০ বছর যাবত ঢাকায় রিকশা মেরামতের কাজ করেছেন। বর্তমানে ধানমন্ডির আবহানী মাঠের পশ্চিম পাশে তার ভাসমান রিকশা মেরামতের স্থান।
কি করে এই পেশায়? বাবা রশিদ মিয়া ছিলেন রিকশা মিস্ত্রী তার কাছ থেকে হাতে খড়ি। তবে রশিদ মিয়া রিকশা মেরামতের পেশা ছেড়ে ফলের ব্যবসায় চলে যান। নাজমা আক্তার রিকশা মেরামতের পেশাটাই স্থায়ী হয়ে গেলেন। এখন ঢাকায় নাজমা আক্তারের শিষ্য আছে গোটা ৩০। নিজের দুই মেয়েও শিখেছে রিকশা মেরামতের কাজ তার কাছে। মেঝ মেয়ে আবহানী মাঠের কাছে রিকশা মেরামত করেন। ছোট মেয়ে রুমি সাথে কথা হল আবহানী মাঠের কাছে। সে জানাল সে রিকশা মেরামতের সকল কাজই জানে। তবে এখন একটা চাকুরী করে। তবে মাঝে মাঝে সময় পেলে মেঝ বোনের দোকানে বসে। বোনের টুকটুাক সহযোগিতা করে।
স্বামী আব্দুর রহমান হৃদয় মিস্ত্রী নাজমা আক্তারের শিষ্য। আব্দুর রহমান বলেন ঢাকায় যদি দুই/চারজন শ্রেষ্ঠ রিকশা মিস্ত্রী থাকে। তবে তার উস্তাদ নাজমার নাম আসবে এক, দুই,তিনের মধ্যে। রিকশার এক্সেলের টাল ভাঙ্গার কঠিন কাজে থেকে শুরু করে চাকায় হাওয়া দেওয়ার মত কাজে আমার ওস্তাদ নাজমা আক্তারের দক্ষতার জুড়ি নেই। বছর বিশ আগে নাজমা আক্তারের শিষ্য হন আব্দুর রহমান হৃদয়। তারপর এখন পর্যন্ত ওস্তাদের সাথে আছেন।
আব্দুর রহমান মূলত সাইকেল সারাতে ব্যস্ত থাকেন বেশি। সাইকেলে সারাতেই তার দক্ষতা বেশি। কিন্তু নাজমা আক্তারের দক্ষতা সবখানে সে রিকশা, সাইকেল, বাচ্চাদের খেলনার সাইকেল-রিকশা সবকিছুতে সে দক্ষ। রিকশা মেরামতের কাজ যতই সহজ আর কঠিন হোক জোর দিয়ে হবে না। রিকশা মেরামত করতে হয় রিকশার সাথে ভাব জমিয়ে। তা না হলে একটা সমস্যা ঠিক হলে আর একটা তৈরি হবে।
ধরেন হাতুরি দিয়ে টুকটুক বারি দিয়ে যেমন রিকশার টাল ভাঙ্গতে হয়। আবার সেই বারি একটু উনিশ-বিশ হলেই রিকশা টাল হয়। রিকশার চাকা বা এক্সেল টাল হলে যে শুধু চালকের রিকশা চালাতে সমস্যা হয় তা নয়। যাত্রীও রিকশায় চড়ে স্বস্তি পায় না। রিকশার চাকায় হাওয়া দিতে হয় পরিমাণ মত। সামনের চাকায় এক রকম, পিছনের চাকাগুলোতে আর এক রকম। আমরা তো হাওয়া মাপার মেশিন ব্যবহার করি না। তাই চোখের মাপ আর অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাদের মাপতে হয়। আমাকে যারা চিনে তারা ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, কলাবাগান, জিগাতলা, রায়েরবাজার যেখানেই থাকুক না কেন আমার কাছে চলে আসে। আমার কাছে কাজ করিয়ে সন্তুষ্ট হয়। নতুন কেউ কেউ ভাবে আমি আর কতটা রিকশা ভাল ভাবে ঠিক করতে পারব। তাই আমাকে এড়িয়ে যেতে চায়। কিন্তু যখন দেখে আমার কাজের মান অন্যদের থেকে ভাল তখন আমার কাজ নিয়ে আর অপত্তি থাকে না। আমি কখনোই কারো সাথে কাজের জন্য র্তকে জড়াই না। আমি আমার মেধা আর আন্তরিকতা দিয়ে কাজ করি। আমার নিজের কাজের প্রতি আমি আস্থাশীল তাই বুঝি কেউ একবার আমার কাছে কাজ করলে বার বার আসবেই। গত ৩০ বছরের তার ব্যাতিক্রম হয়নি।

সারাদিন রিকশার টাল ভাঙ্গে, বাড়ি ফিরে সংসারে টাল ভাঙ্গতেও পারদর্শি নাজমা
এখন স্বামী-স্ত্রী কাজ করে কুলাতে পারি না। প্রতিদিন শত শত রিকশা আসে আমাদের এখানে। ঢাকায় হাজার হাজার মানুষ রিকশা চালায় কিন্তু মানুষগুলোর কোন দাম নাই। একদিন গাড়ি বন্ধ থাকলে কত হাউকাউ। কিন্তু একদিন যদি রিকশা বন্ধ থাকে তাহলে কি হবে চিন্তা করেন? তারপর মানুষ রিকশা চালকদের সম্মান করে না। মাঝে মাঝে মাইর খাইয়া রিকশা চালকরা আসে। পুলার সমান পুলাপাই মারছে ভাড়া দেয় নাই। রিকশা ভাইঙ্গা দিচ্ছে। গত ৩০ বছরে কত রিকশা ড্রাইভারে চোখের পানি দেখছি। কত রিকশা ড্রাইভার দেখছি শূণ্য থেকে কত কি হয়ে গেলে।
একজন কর্মীজীবি নারীর পরও আমার পরিচয় আমি কারো মা, স্ত্রীর সংসার আমাকে সমালাতে হত। রাস্তায় রিকশার টাল ভাঙ্গি আর বাসায় সংসারের টাল ভাঙ্গি। ভিক্ষা করা থেকে রাস্তায় বসে রিকশা মেরামতের কাজ অনেক ভাল। আমি আমার শ্রম,বুদ্ধি দিয়ে কাজ করি। কারো কাছে হাত পাতি না। এটাই আমার সুখ।

No comments:

Post a Comment