Thursday, March 10, 2016

দুধই যাদের গলার ফাঁস!


দুধই যাদের গলার ফাঁস!


সৈয়দ সাইফুল আলম, বাংলামেইল২৪ডটকম

ঢাকা : রাজধানীর ধানমণ্ডি থেকে মাত্র মিনিট ১৫ সময় লাগে অটোরিকশায় যেতে। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড আর রায়ের বাজার থেকে আটিবাজারে কয়েক মিনিট পর পর অটোরিকশা যায়। এ বাজারে গরুর দুধ নিয়ে আসেন রফিকুল, ননীগোপাল, নেপালী, হাজি সাহেবসহ অনেক গোয়াল। 
হাজি সাহেবের পাঁচ গাভী আর একটি ষাঁড়। খাঁটি দুধের নিশ্চয়তা, সঠিক ওজন আর সততার জন্য হাজি সাহেবের সুনাম গ্রামজুড়ে। তার বাড়িতে গরুর দুধ নিমিষেই বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু রবি আর সোমবার দুধই তার গলার ফাঁস। কারণ এ দু’দিন পাইকার আসে না। তাই দুধ বিক্রি তেমন হয় না। দুধের দাম ওই দিনগুলোতে ৩০ থেকে ৩৫ টাকায় ওঠানামা করে। 
গেল সোমবার আমরা হাজির হলাম আটিবাজার মসজিদ মার্কেট দুধবাজারে। তেমন কোনো ক্রেতা নেই। মণ মণ দুধ আসছে আটি, ওয়াশপুর, আটি ভাওয়াল, তারিপাড়া, বাবুনসুর, শিকারিটোলা, আটি বাড়ালিয়া, গাটারচর, জয়নগর থেকে। ক্রেতা শুধু আমরা তিনজন। ‘কত মণ দুধ কিনবেন? ৩০, ৩৫, ৪০ যা চান তাই দেন। আমাদের উদ্ধার করেন।’ 
আমাদের স্থানীয় প্রদর্শক আগেই খামার ঠিক করে রেখেছেন দুধ আনার জন্য। খামার মালিকের বাড়িতে আমাদের খাওয়া-দাওয়ার করা আয়োজন হয়েছে। এ দামে দুধ কিনে তার বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া নেহাত অন্যায়। কিন্তু কিছুতেই না খাইয়ে ছাড়বে না। প্রয়োজনে দুধ বিক্রির দরকার নেই। 
আমরা একের পর এক গ্রাম পার হচ্ছি। শুধুই গরু আর গরু। বলা যায়, গ্রামগুলো এখনও গরুর গ্রাম! ঢাকা থেকে শুধু নদী দিয়ে বিচ্ছিন্ন এই গ্রামগুলোর চিত্র। এখনও আপনি চোখ বন্ধ করে যে গ্রামের ছবি দেখেন ঠিক তেমনি।
গ্রামের মানুষগুলো এখনও গরুগুলোকে তাদের পরিবারের অংশই মনে করে। প্রতিটি গরুর আলাদা আলাদা নাম আছে। গরুর জ্বরে মালিকও আক্রান্ত হন। সারারাত জেগে গরুর সেবা করেন তারা। এই গ্রামগুলোতে একটি গরুর বাচ্চার জন্ম যেমন আনন্দের সংবাদ হয়ে আসে তেমনি একটি গরুর মৃত্যুও হাহাকার আনে। 
আশপাশে কিছু ঘোষ বাড়ি আছে। তারা দুধ থেকে মিষ্টি, ঘি, মাখনসহ নানা প্রকার দুগ্ধজাত খাবার তৈরি করেন। কিন্তু তা উৎপাদিত দুধের তুলনায় অনেক কম। তাই স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে অফুরন্ত দুধই গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়ায় ঝড়, বৃষ্টি, হরতালসহ বিভিন্ন বন্ধের দিন। 
দুপুরের পর পর আমাদের ফেরার পালা। আসার পথে আমিনুল এসে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ‘ভাই কোক-পেপসি না খাইয়া এক সের দুধ খাইয়েন, স্বাস্থ্য ভাল থাকব, দামেও সস্তা। আমাগো মতো হাজার হাজার গোয়াল আর গরু বাঁচবো, যদি মাইনষে নিয়মিত দুধ খায়।’ 
আমরা একটা বিশাল অপরাধবোধ নিয়ে অটোরিকশায় করে ঢাকায় ফিরছি জনপ্রতি ভাড়া মাত্র ১৫ টাকা। কারও মুখে কথা নেই। আমরাও এ মানুষদের বিপদের সুযোগ পেয়ে সস্তায় ১ মণ দুধ কিনে বাড়ি ফিরছি। কিন্তু আমি ভালো করে জানি, আগামীকাল আমাকে প্রতি কেজি দুধ ৯০ টাকা করে কিনতে হবে শহরের দোকান থেকে। 
ধানমন্ডি থেকে মাত্র ৫-১০ কিলোমিটার দূরে গ্রাম আর শহরের মধ্যে কী করে প্রতি কেজি পণ্যের দাম তিন গুণ বাড়ে, এ এক বিস্ময়!  মাঝের মুনাফাকারীদের শৃঙ্খলটা ভেঙে যদি অন্য কোনো একটা সুযোগ তৈরি করা যায়, তাহলে কিন্তু হাজার হাজার কৃষক বেঁচে যান। সবুজ গ্রামগুলো সবুজই থাকবে। এই শহরের শিশু-বৃদ্ধরাও কৌটার দুধের স্বাদ নয় কিংবা খাঁটির নামে শুধু বিজ্ঞাপননির্ভর নানা রাসায়নিক উপাদানের দুধ থেকে মুক্তি পাবে। 
উৎপাদন বৃদ্ধি, বাজার, চাহিদা, গবেষণা কতই না ছোটাছুটি হলো! কিন্তু ঢাকার কাছের এই গ্রামের কৃষকদের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হওয়া প্রমাণ করে, আমাদের তৃণমূলের কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণে কতটা অসহায়।

No comments:

Post a Comment