Tuesday, November 22, 2016

পেশায় তারা ভূতওয়ালা।

না ভুল শুনেনি। পেশাই তাদের ভূতওয়ালা। ভূতই তাদের রুটি,রুজি। ভূত নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ান। গ্রামের ছেলে-বুড়ো সবাই ‍ভূতওয়ালা বলেই জানে তাদের। আর আমিতো ভূত দেখতেই গেলাম। 
সারারাত ট্রেন জার্নি (ভ্রমণ করে) যখন আমরা পৌঁছালাম ভূতওয়ালাদের গ্রামে তখন বেলা শুরু। বছরে এই সময় তাদের কাজের চাপ কিছুটা থাকে। তবে চৈত্র মাসে চাপ খুব বেশি। ঐ সময় ভূতওয়ালাদের ঘুমও নাকি হারাম।
তবে আজ ভূতওয়ালাদের বিন্দুমাত্র সময় নেই আমাদের সাথে কথা বলবে। গত রাতে উত্তর পাড়া থেকে ডাক এসেছিল। সন্ধ্যার আগে আগে যেতে হবে আরো তিন বাড়ি। সারারাত উত্তর পাড়ায় ভূত নিয়ে কাজ করতে হবে। 
এ বাড়ি ঐ বাড়ি সবার ডাকাডাকি ও ভূতওয়ালা আমাদের বাড়ি আসো তোমার ভূত নিয়ে। ভূতের কদর, ভূতওয়ালার কদর। আমাদেরও কদর কম নয়। আমরা মেহমান। তাই হাজার ব্যস্ততার মাঝে বাড়ির লোকজন আমাদের খোঁজ খবর নিচ্ছেন। আমরা তাদের কাজের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে চলে আসলাম। অবসরে দেখা হবে। কথা হলে আড্ডা। শহরবাসীও না হয় জানাব কে ভূতওয়ালা । কি ভূত তারা পোষেন।






ওরা তিনজন ভূতওয়ালা।

এ কেমন পেশা?
মাসখানিক পর আমরা আবারও গেল ভূতওয়ালাদের গ্রামে। ওহ ভূতওয়ালা একটু সময় হবে ভাই? না সময় নেই। নতুন ফসল আমাদের তাদের নাওয়া খাওয়া কেড়ে নিয়েছে। আমি তিনজের দলে আর একজন । সারাদিনের জন্য দিনমজুর হয়ে গেলাম। খাওয়া ফ্রি। বিনিময়ে কোন টাকা মিলবে না।

পাবনার বিভিন্ন গ্রামে ভূত ও ভূতওয়ালাদের দেখা মিলবে। তারা গ্রামে গ্রামে ছুটে চলেন ভূত নিয়ে। ভূত এক ধরনের মটর চালিত মাড়াই যন্ত্র। ধান, গম,ভুট্টা, তিল, তিশি, মাসকলাই, সরিষাসহ নানা ফসল মাড়াই করা হয় এই মেশিনের সাহায্যে। এই মেশিনের একদিকে দিয়ে পুরো কান্ডসহ বিভিন্ন ফসল ডুকিয়ে দেওয়া হয়। অন্যদিক দিয়ে ফসল ও উচ্ছিষ্ট আলাদা হয়ে বের।




ফসল মাড়াই যন্ত্র ভূত।

এই মেশিনের নাম স্থানীয় ভাবে ভূত । যারা মেশিন চালায় তারা ভূতওয়ালা। ভূতওয়ালাদের নিয়ে গ্রামে নানা কথা প্রচলিত আছে এখন। বলা হয় ভূতওয়ালাদের পেট নাকি ভূতের ন্যায়। আস্ত গরু খেয়ে ফেলতে পারে তারা। ধান,সরিষা,ভুট্টা,তিল,তিশি, মাসকলাই যাই মাড়াই করা হোক ভূতওয়ালাকে প্রতি মণে তিন কেজি দিতে হয়। সাথে খাবার সারাদিনের খাবার, পান, চা, বিড়ি তো আছেই।




আমি ভূতের ভাগ বুঝে নিচ্ছি। প্রতি মণে তিন কেজি।

উত্তরপাড়া যাবার আগেই আমি ক্লান্ত দেহ নিয়ে চলে আসলাম। সারা শরীরে আমার মাসকলাইয়ের গন্ধ। সবাই আমাকে নবান্নের আমন্ত্রণ দিল। আর মাসখানি পর শুরু হবে নবান্ন উৎসব। শহুরে সেই ব্যানার, পোস্টার, পত্রিকার পাতায় কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সেই স্বাদ-গন্ধহীন কৃত্রিম নবান্ন উৎসব নয়। এই গ্রামে নবান্ন মানে দলে দলে গ্রামের মেয়েরা বাড়ি আসবে। সাথে শিশুরা। জামাইদের জন্য শত পদের পিঠা বানানো হয় এই গ্রামে। 
ভূতের মালিক সামছু ভাই আমাকে এগিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন। ভাই ভূত মেশিন ভাল না। অনেক মানুষ বেকার হইয়া গেছে। দশজনের কাজ একাই করা যায়। এতগুলা মানুষের রুটি-রুজি শেষ করে দিল। 
আসলেন আর যাবেন। একদিন থেকে যান। তিলের পিঠা বানাবে আপনার ভাবি। কিছুই তো খাওয়া হল না। থাকলে সমস্যা কি একদিন বেশি থাকলে। একদিনের সম্পক তার চোখে পানি। একদিনের সম্পর্কের সামছু ভাই আমার স্মৃতি চাঁদের মত উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন।
আমি সন্ধ্যার ট্রেনে ঢাকায় ফিরছি। সারা আকাশ জুড়ে আজ চাঁদের রাজত্ব। আজব চাঁদ। আমার ঢাকায় ফিরতে ইচ্ছে করছে না। জয়দেবপুর নেমে গেলেই ভাল হয়। ঢাকার আকাশে চাঁদ ভাল লাগে না। ঢাকার আকাশে ধূলার স্তর অনেক বেশি। তাই চাঁদের রূপ ভাল ভাবে উপভোগ করা যায় না। 
এই নবান্নে না হোক পরে নবান্নে পাবনার, চাটমোহর,অটলংকার গ্রামের সেই চিকনাই নদীর পাড়ের চাঁদ আর ভূতওয়ালা সামছুর দুজনের সাথে আবার দেখা হবে। এই প্রত্যাশা নিয়ে আরো কয়েক যুগ বাঁচতে চাই।

No comments:

Post a Comment