Monday, October 31, 2016

বাংলাদেশের যে গ্রামে ফ্র্রি থাকা খাওয়া ব্যবস্থা আছে ।

পৃথিবীর যে কয়টা মেগাসিটিতে কমদামে থাকার হোটেল পাওয়া যায় তার মধ্যে ঢাকা অন্যতম। এক ডলারের কিছু বেশি খরচ করলে ঢাকায় থাকার হোটেল মিলে। তাও আবার ভাসমান থাকার হোটেল। এই খবর টি এখন আর্ন্তজার্তিক গণমাধ্যমের কল্যানে সারা পৃথিবীর ভ্রমণপিয়াসী মানুষ জানে।  
কিন্তু বাংলাদেশে টাকা ছাড়াই থাকার ব্যবস্থা আছে। আছে খাবারের ব্যবস্থা। নিরাপত্তা, সামাজিক দায়বদ্ধতা, সহযোগিতা আর তারচেয়ে বড় কথা মানুষের বিপদে মানুষের পাশে মানুষ থাকবে। মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার এই সংস্কৃতি একটা দুইটা জায়গা নয়। গ্রামের পর গ্রাম মিলবে এই সংস্কৃতি।
আমার নেশা ঘুরে বেড়ানো। আর এই নেশার সাথে যুক্ত কত কম খরচে ঘুরে বেড়ানো যায়। কোথাও যদি বিনামূল্যে থাকা, খাওয়া যায় তাহলে তো কথাই নেই।
ব্যাগ, পানির বোতল আর সেলফোন নিয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে বেড়িয়ে পড়লে বাংলাদেশে কোথাও আটকাতে হয় না। প্রতিবার হয়েছে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। যুক্ত হয়েছি নতুন নতুন মানুষের সাথে। আর ভ্রমনের নেশাটাও তাই গরীবের ঘুরা না হয়ে আর্শিবাদ হয়ে গেল।
গন্তব্য উত্তরবঙ্গ। আমাদের তাড়া নেই। তারপরও দ্রুতযান নামের ট্রেনের চেপে বসলাম। বরাবরের মত শেষ সময়ে ট্রেনে সিটসহ টিকেট পেয়ে গেলাম। ট্রেন দ্রুততার সাথে গন্তব্যেরে দিকে যাচ্ছে। আমার সহ ভ্রমণকারী যাব কোথায়? থাকব কোথায় তা নিয়ে কোন প্রশ্ন করছে না। ট্রেনে কথা বলে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত যেখানে যাব সেখানে কোন হোটেল নেই। ট্রেনে সবাই বুদ্ধি দিল সারারাত চাটমোহর স্টেশনে থেকে সকালে হবার জন্য। রাতে এই অঞ্চল নাকি নিরাপদ নয়।
ট্রেন রাত ১.০০টার পর চাটমোহরে পৌছল। স্টেশনের লোকজন জানাল আশেপাশে কোন থাকার হোটেল নেই। একটু ভিতরের গ্রামে গেলে ও“খানকা ঘর” এ থাকতে পারবেন। আমরা রাত একটায় চাটমোহর স্টেশন থেকে বের হয়ে রওনা হলাম। দেখি থাকার কোন ব্যবস্থা হয় কিনা?
মিনিট ৩০ র্নিজন রাস্তা চলার পর চাটমোহর স্টার হোটেলের মোড়ে এসে জানলাম স্টার হোটেল থাক নয়, খাবারের হোটেল।  

আমরা চাটমোহর মোড়ে ৮০+ বয়সী নিরাপত্তা প্রহরী চাচার সাথে রাত কাটিয়ে দেওয়াটাই নিরাপদ ভাবলাম। চাচা জানাল বাস স্ট্যান্ডের মোড়ে একটা থাকার হোটেল আছে।
সেলিম বোডিং। এত রাতে এই বোডিংয়ে অতিথি রাখে না। আমাদের সব সম্ভবের অপু সেলিম বোডিংয়ের মালিককে ঘুম থেকে ডেকে আমাদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করে ফেল। ভাড়া ৮০টাকা । সারারাত ছারপোকার সাথে লড়াই করে ভোরে রওনা হলাম আটলংকার উদ্দ্যেশে। চারিদিকে ফসলের মাঠগুলো এখন বিশুদ্ধ সবুজ। এখানে নদীর জলও সবুজ। নদীর নাম চিকনাই। এই নদীর পাড়ের গ্রাম আটলংকা আমাদের গন্তব্য। আটলংকা সত্যি সুখী গ্রাম। এই গ্রামে গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ, চিকনাই নদীর মিঠা পানি।
গ্রামের মানুষগুলো তাদের গ্রামে দূর দূরান্তের মানুষের বিশ্রাম বা সাময়িক আশ্রয়ের জন্য তৈরি করেছে “খানকা ঘর”। এক সময় প্রতিটি অবস্থা সম্পন্ন বাড়ির সামানে একটি করে খানকা ঘর রাখাই বাধ্যতামূলক ছিল। এখনও আছে তবে তার সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
সেই কমে যাওয়ার মাঝেও একটি খানকা ঘর আটলংকা, বউ বাজার সংলগ্ন বাড়ির খানকা ঘর।
কথা হয় চেয়ারম্যান বাড়ির ছোট ছেলে মো: রফিকুল ইসলাম সাথে। তিনি পেশায় শিক্ষকতা করেন। জন্মের পর থেকে খানকা ঘর দেখে আসছে তিনি। আগে গ্রামের বেশির ভাগ বাড়িতেই ছিল। আমারও এখনও ঘর রক্ষনাবেক্ষন করছি।
ঝড়, তুফান দিন কিংবা পথিক ক্লান্ত হলে এই ঘরে আশ্রয় নেয়। আমরা সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের সেবা করি।
এক সময় এই গ্রামগুলোতে প্রচুর লোক আসতো বিভিন্ন জায়গা থেকে নানা কাজে। এখনো আসে ফসলের সময় প্রচুর মানুষ আসে দূরদুরান্তর থেকে। মানসিক ভারসাম্যহীনরা আশ্রয় নেয়। সবারই আশ্রয় জুটে এখানে।
আমাদের খানকা ঘরে দরজা নাই। তার অর্থ আপনি দুনিয়ার যে প্রান্তের মানুষ হন না কেন খানকা ঘরে আপনার থাকার অধিকার আছে। আপনি যখন আশ্রয় পেয়েছেন। খাবার জোগাড় হবেই। রিজিকের মালিক আল্লাহ। গ্রামের একজনের খাবার থাকলে মেহমান খালি মুখে যাবে না খানকা ঘর থেকে।
খানকা ঘরের পাশেই পুকুর পথিকের পানির চাহিদা পূরণের জন্য খনন করা হয়েছিল। আমরা খাওয়া দাওয়া শেষ করে খানকা ঘরে বসে আছি। দুপুর বেলায় পুকুর পাড়ে শান্ত পানিতে সাদা-কালো ফুটফুটে মাছরাঙ্গার মাছ শিকার দেখছি। একটু দূরে চিকনাই নদীতে শুনতে পাচ্ছি নৌকা বাইচের জন্য নৌকা যাচ্ছে । সৌখিন মাঝিদের কণ্ঠে গান। এই গান সুখের গান। গ্রামের মা-বৌরা কড়তালি দিয়ে উৎসাহ জোগাচ্ছে। বিকেলে ছেলে বুড়ু সবাই যাবে নৌকা বাইচ দেখতে। এ উপলক্ষ্যে মেলা বসবে। সবার অনুরোধ নৌকা বাইচ দেখতে যাবার জন্য।
কিন্তু আমাদের তাড়া। ঢাকায় ফিরতে হবে।
মাত্র কয়েক যুগের ব্যবধানে আমার আরবান লিভিং কন্সেপট এর অন্তজালে জীবনকে আমি আর তুমিতে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। আমাদের এই নাগরিক জীবন ধারা যখন একটি প্রজন্মকে শেখাছে জীবন মানেই শুধুই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা কিংবা শুধুই মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া।
সেখানে উন্নত জীবনের পরিকল্পিত ছক আঁকতে গিয়ে এই বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিরোধে চাটমোহর থানার বিভিন্ন গ্রামের খানকা ঘরগুলো সামাজিকতা, মানবতা, মানুষের পাশে মানুষ দাড়ানো শেখানোর জীবন্ত বিশ্ববিদ্যালয়।
এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মূল্যায়ন করা এবং তা থেকে অর্জিত জ্ঞান যদি আমার আমাদের নগরায়নের পরিকল্পনায় অর্ন্তভুক্ত করতে পারি। তবে আমরা আর বিচ্ছিন্ন হব না। আমাদের আগামী প্রজন্মটা শেকড়হীন হয়ে পড়বে না।
শুভ কামনা আটলংকা গ্রামবাসী। আপানাদের ঐক্য, সামাজিকবন্ধন সারাদেশের জন্য উদাহরণ হোক।

No comments:

Post a Comment