Wednesday, October 15, 2014

শিশুদের জন্য মুরগীর আস্ত রান। ক্যামেরা আর ব্যান্ডিং নিষিদ্ধ

ভোর ৫টায় আমাদের রওনা হবার সময় ঠিক করা হল। গন্তব্য আনন্দপুর। আনন্দপুর দুনিয়ার কোন প্রান্তের গ্রাম। সেই গ্রামে কি আছে, কেন যাচ্ছি, তার কোন কারণ জানি না। গাড়িতে উঠেই আমি ঘুম দিলাম।  ঢাকা ময়মনসিংহের ভাঙ্গা রাস্তা পারি দিতে গিয়ে। আনন্দপুরে যাওয়া নিয়ে আমার আনন্দ শেষ হয়ে গেছে। তারপরও আমি ঘুমাচ্ছি। ময়মনসিংহের মানুষের সময় জ্ঞানের জন্য বিখ্যাত। কারণ তারা যদি বলে এক ঘন্টার রাস্তা । তবে আপনি নিশ্চিত ‘ ঘন্টা তিনের রাস্তা পারি দিতে হবে। আমি একপ্রকার ঘুমিয়ে ময়মনসিংহে পৌঁছি। তারপর রানা ভাই বললেন নাস্তা করে নিতে হবে। কারণ সামনে খাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। নাস্তা সেরে শহর থেকে মিনিট ৪০ গাড়ি চলার পর। গাড়িটি গ্রামের মাটির রাস্তায় নেমে পড়ে। যে বাড়ির উঠানে আমাদের গাড়ি থামানো হয়েছে, সেই বাড়ি ভর্তি শিশু। রানা ভাই ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে শিশুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। এর নাম আসাদুল, এর নাম মানিক মিয়া, এর নাম .......................।

একটু পর খাওয়া দাওয়া শুরু হবে। সবাই খাবারের আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত। অনেক কিছু রান্না করা হয়েছে। আমরা স্থানীয় মানুষজনের সাথে গল্প করছি। হুট করে দেখি রানা ভাই বিষ্ফোরণ। খুবই রাগারাগি করছেন। কয়েকজনের সাথে। রাগের কারণ, কেন একটি মুরগী কম জবাই করা হল। ঘোষনা করা হল খাবার দিতে দেরি হবে। কারণ মুরগী জবাই করা হবে, তারপর আবার রান্না হবে। তারপর খাওয়া শুরু।


আমি রাধুনীর সাথে গল্প করছি। এই মহিলার হাত স্বর্ণ দিয়ে বাধাই করা উচিত বলে শুনেছি। রাধুনীর কাছে তার রান্নার রহস্য কি জানতে চাইলাম। সে শুধুই হাসে। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম রানা ভাই কেন বকা দিলেন? বাইচ্চা একটা বাইরা গেছে। ১৪জনের জন্য ৭টা মুরগী জবাই করছিলাম। সকালে আর একটা বাইচা আইল। মোট ১৫টা বাইচা। আমি মনে করলাম। ১৪টারে একটা কইরা রান দিমু। আর একটারে সিনার বড় টুকরা দিমু। কিন্তু মামায় মানে না। কয় ক্যান ১৫টা রান রান্না করি নাই। যাই হোক মুরগীর রান রান্না হচ্ছে।

এই গ্রামের সকল দরিদ্র এতিম শিশুর জন্য আজ মুরগীর আস্ত রান রান্না করা হয়েছে। আমি ভয়ানক  ক্ষুদা নিয়ে বসে আছি। শিশু ছাড়া এই খাবার আয়োজনে অন্য কারো অংশগ্রহনের সুযোগ নেই। কিছুক্ষনের মধ্যে খাবার বিতরণ শুরু হল। প্লেইট ভর্তি ভাত আর আস্ত মুরগীর রান। শিশুরা মুরগীর রান খাচ্ছে। চোখের পানি, নাকের পানিতে মুরগীর রানের মিশে একাকার। কেউ কেউ রান নিয়ে বসে আছে।  এখন খাবে না মুরগীর রান বাড়িতে নিয়ে খাবে।

আমি রানা ভাইয়ের পাশে বসে শিশুদের রানা খাওয়া দেখছি। এই শিশুদের অনেকের জীবনের আজ প্রথম রান খাচ্ছে। কারণ তাদের কারো মা,বাবা নেই। দাদা- দাদী কিংবা  কারো তাও আশ্রয় নেই। রক্ত সম্পর্কহীন গ্রামের কারো আশ্রয়ে বেঁচে আছে। এই শিশুদের কপালে যদি কখন মুরগীর মাংস জুটে কিন্তু কোনদিন মুরগীর রান জুটে না। রানা ভাই তাদের জন্য রান খাওয়ার প্রোগ্রাম চালু করেছেন।

জীবনে বহুবার মুরগীর রান খেয়েছি। কিন্তু আমার আজ মুরগীর রানের প্রতি লোভ সামলাতে পারছি না। কিন্তু রানা ভাইয়ের কঠোর নিষেধ শিশুদের খাওয়ানোর আগে পরে কেউ খাবার খেতে পারবে না। আমি রানা ভাইয়ের কাজ কর্মে কোন যুক্তি তর্কে যাই না।  আমি আমার জি১২ ক্যামেরা বের করে প্রস্তুতি নিলাম ছবি তোলার। এই মূহুর্তগুলো যদি ক্যামেরা বন্দী না করি তবে না-ই হবে। কতগুলোর শিশু হাসি মুখ ছবি। প্লেইট ভর্তি মুরগীর আস্ত রান। আমি একটা ছবি তোলেছি। রানা ভাই এসে জানিয়ে দিলেন ছবি তোলা যাবে না। আমি বললাম কেন। কাউকে খাবার খাইয়ে তার প্রতিদান চাও মানে ব্যবসা। এটা ব্যবসা নয়। আমি যুক্তি দিলাম রানা ভাই ব্যবসার কথা কেন বলছেন। এই ছবি দেখে অনেক তরুন-তরুনী এগিয়ে আসবে। নাহ শিশুরা খাবার খাচ্ছে এই ছবি প্রচার করার অধিকার আমার নেই। এই ছবি দিয়ে আমি কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই না। এই ছবি আমি নিজে দেখতে চাই।  প্রয়োজনে আপনি নিজেও জীবন্ত এই ছবি তৈরি করতে পারেন।

আমি বললাম ঠিক আছে আপনি যখন আগামীতে এই রকম আয়োজন করবেন আমি ঢাকা থেকে প্রচুর সেচ্ছাসেবক নিযে আসব।

তিনি সরাসরি প্রতিবাদ করলেন। নাহ আমি গ্রামে এই শিশুদের খাবারের আয়োজন করেছি। শহুরের একদল তরুণ তরুনী দয়া-মায়া মাখানো মুখ নিয়ে শিশুদের খাবার খাওয়াছে। আমি এই রকম একটা নষ্ট বিষয় কল্পনাও করতে চাই না। শিশুগুলোর সারা জীবন ভাববে তারা শহরের ধনী মানুষের দয়াতে মুরগীর রান খেয়েছে। আর শহরের তরুণগুলোর ধারনা হবে তারা গ্রামের গরীবদের খাওয়াতে পারে। দুইয়ের মধ্যে ব্যবধান তৈরি হবে। প্রয়োজনে  তোমরা ঢাকায় আয়োজন কর। কি দরকার ঢাকা থেকে হাজার টাকা খরচ করে এই গ্রামে আসার। বরং যাতায়াতের টাকা দিয়ে আরো বেশি শিশুদের রান খাওয়ানো যাবে।

যাই হোক ভাই আমার খিদা লেগেছে খেয়ে নি। নাহ এখানে খাওয়া যাবে না। কারণ আমি এবং আমার আত্মীয়রা এই খাবারের জন্য আমাকে টাকা দিয়েছে তা শুধুমাত্র এতিম শিশুদের জন্য। এই খাবারে অন্য কারো হক থাকতে পারে না। আমরা যাওয়ার পথে ময়মনসিংহ শহরে খাব।

ঝড়, গাড়ি নষ্ট নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে আমরা অনেক রাতে ঢাকায় ফিরলাম। আমার চোখের সামনে ভেসে বেড়াছে একদল শিশুর মুরগীর রান খাওয়ার ছবি। এক বৃদ্ধার জীবনে প্রথম নাতির মুখে মুরগীর আস্ত রান তুলে দেওয়ার সুখের কান্না। এই ছবিগুলো আমার কাছে সারাজীবনের জন্য জীবন্ত।

প্রিয় রানা ভাই
আপনি জেনে  আনন্দিত একদল তরুন আগামী ১৮ তারিখ ঢাকা শহরের  প্রায় ৩০০ শিশুর জন্য  খাবারের আয়োজন করেছে।  শিশুদের এই আয়োজনে তারা সকল প্রকার ব্যান্ডিং ও ক্যামেরার ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। আমি বিশ্বাস এই তরুনরা ক্যামেরা আর ব্যান্ডিং নিষিদ্ধ করে এই নগরে সেচ্ছাসেবার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যাচ্ছে।

Monday, October 6, 2014

বুড়িগঙ্গার অন্য রূপ।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর ছিল নদী দিবস। এই দিনে নদীকে ভালোবাসে এমন দুনিয়াব্যাপী কোটি মানুষ নদীর পক্ষে লড়াই করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় মনে প্রাণে। নদীর প্রতি ভালোবাসার এই দিবসে কয়েকজন নদী প্রেমিকের সাথে গিয়েছিলাম বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষা রাজধানীর একমাত্র জেলেপল্লীতে।

বুড়িগঙ্গায় অক্সিজেনের মাত্রা কত? বিষাক্ত গ্যাস কোনটা কত আছে? কোথায় কী দূষণ হচ্ছে? নদী নিয়ে দুর্নীতি হাজারো সংবাদ পড়ি এই নদীটাকে নিয়ে। কিন্তু বুড়িগঙ্গার আরো অনেক রূপ আছে। কাশফুল, বক, মাছরাঙ্গা, পাল তোলা নৌকা, জেলে, মাঝি, নদীকে ঘিরে কতোসব উৎসব যে এখনো টিকে আছে তা অজানাই রয়ে গেল!  আজ জানাবো নদীর অন্যরূপ। অন্য একদল মানুষের কথা যারা এখনো এই নদীনির্ভর। তাদের জীবন জীবিকা এই নদীকে ঘিরে। প্রতিনিয়ত সংগ্রামের পাশাপাশি  তারা স্বপ্ন দেখে আবারও এই নদীটায় বর্ষায় রুই, কাতলা, বোয়াল, পুঁটি ধরা পড়বে ঝাঁকে ঝাঁকে। শীতকালে বাড়া/ঝাপ (গাছের ডাল-পালা দিয়ে নদীতে মাছ ধরার ফাঁদ) থেকে আবারও শিং, মাগুর, কৈ, বাইম ধরা পড়বে। এখনো বর্ষায় এই নদী যাদের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম উৎস। বুড়িগঙ্গার জলেই যাদের ঘর-সংসারের অধিকাংশ কাজ চলে। সেই মানুষদের গল্প দেখতে আর শুনতে বুড়িগঙ্গা রিভার কিপার শরীফ জামিল ভাই নদী দিবসে আয়োজন করেন জেলেদের সাথে আড্ডা। বুড়িগঙ্গার পাড়ে জেলেদের জেলে পেশায় টিকে থাকার গল্প শুনে আপনিও অবাক হবেন। এত দূষিত নদীতে কি মাছ থাকে? এই শহরে এখনো কী করে শত বছরের জেলে পাড়ার লোকগুলো তাদের পেশায় টিকে আছে? গ্রামের তরুণরা তাদের প্রবীণদের কাছ থেকে এই নদীর অনেক গল্প শুনেছে। কে কত বড় মাছ ধরেছে এই নদী থেকে? জেলেপাড়ার মানিক রাজবংশী গর্বের সাথে বলেন, এক যুগ আগেও মাছে ভরে যেত নৌকা। তিনি জানালেন, বছর কয়েক আগেও এই পল্লীতে অসংখ্য জেলে-জাল-নৌকা ছিল।  মানুষগুলোর মাছ ধরা-কেনা-বেচাই ছিল প্রধান পেশা। বেপারিরা অগ্রিম টাকা দিয়ে যেত। ফরিদপুর, পাবনা থেকে লোক আসত এই পল্লীতে রোজ কামলা খাটতে। গেল বছর শেষবারের মতো এসেছিল লোক। এই বছর আসে নদীতে মাছ নেই। তাছাড়া সারা রাত খেটে পাওয়া যায় জন প্রতি পঞ্চাশ থেকে দুইশ টাকা।

এখন ডিপজল, সোয়ারি ঘাট, কাওরান বাজার, নিউমার্কেট থেকে পাইকারি বাজার থেকে মাছ কিনে রায়েরবাজারে বিক্রি করে। অনেকে ভিটে-বাড়ি বিক্রি করে কলকাতায় চলে গেছে। যারা গেছে তাদের তালিকায় নিজের পরিবারের লোকও আছে। কিন্তু তিনি যেতে পারেননি। বলতে থাকেন মানিক রাজবংশী।

বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের ভিটা। শুধু যে ভিটার টানে থাকি তা নয়। নদীর প্রতি একটা টান পরে গেছে কয়েকবার যেতেও চেয়েছি। মন সায় দেয় না। শান্তি পাই না। কেমন জানি মনে হয় নদীতে আবারও মাছ পড়বে। আমি নৌকা, জাল সব বিক্রি করে দিয়েছি বেপারির দেনা শোধ দিতে। তবে মাছ পড়লেই আবার জাল নিব। মাছ কিনে বিক্রি করে সুখ নাই। মাছ ধরে বিক্রি করাতে আলাদা আনন্দ আছে। এক নিঃশ্বাসে বলে যান আশাবাদী রাজবংশী।

সন্ধ্যায় নদীতে দেখা হলো সুবল রাজবংশীর সাথে। তিনি এখনো প্রতিরাতে মাছ ধরতে যান নদীতে। তার মতো আরো সাতটি নৌকা টিকে আছে এই জেলেপাড়ায়। সন্ধ্যার পর তারা আটজনের দল যান নদীতে। সারা রাত মাছ ধরে সকালে বেপারিরা মাছ বিক্রি করে রায়ের বাজারে। মাছের পরিমাণ এখন খুবই কম তবুও বাপ দাদার পেশাটা আঁকড়ে ধরে আছেন।

সারা বিকেল জেলেদের সাথে আড্ডার পাশাপাশি উপভোগ করলাম বুড়িগঙ্গার অন্য রূপ। বর্ষায় কিন্তু জেলেপাড়াটা পুরো ভিন্ন রূপ ধারণ করে।  নদীর তীর ঘেঁষে কাশ ফুল। সারি সারি মাছ ধরার নৌকা, তীরে ছড়ানো মাছ ধরার জাল, স্বচ্ছ পানি- কী নেই এই নদীতে? এই সবই এখনো অল্প পরিসরে হলেও দেখা যাবে বুড়িগঙ্গার তীরের জেলেপাড়াতে। বর্ষার এই স্বচ্ছ জলে শুধু পাওয়া যাবে না মাছ। কিন্তু মাছ ধরাই যাদের চৌদ্দপুরুষের পেশা, নেশা। তাদের জন্য নদীর অর্থ অনেক। নদী তাদের কাছে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, জীবন-জীবিকা, উৎসব আরো কত কী! তাই তো সুবলের কণ্ঠে কলকলিয়ে বেরিয়ে আসে- যতই কাল হোক নদীর জল এই নদীকে ঘৃণা করি কী করে? এখনো তো তার কৃপায় বেঁচে আছি।

সন্ধ্যার পর পর আমরা চলে আসছি মেঠো পথ ধরে, উদ্দেশ্য বছিলার প্রধান সড়ক থেকে গাড়িতে উঠবো। জেলেপাড়ার নারী-পুরুষ, বাচ্চারা গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল। গাড়িতে উঠার আগ মুহূর্তে এক বয়স্ক লোক শরীফ ভাইয়ের হাত চেপে ধরলো। ‘বাপ নদীটারে আগের মতো করে দাও। মরার আগে আমি নদীটারে আগের মতো দেখতে চাই’- নদীর জন্য মানুষটা কাঁদছে। এই জেলের চোখের জল শুধু কি নদীর জন্য? নাকি নদীকেন্দ্রিক তার ভালোবাসা, যে ভালবাসার জন্য সবাই চলে যাওয়ার পরও বৃদ্ধ ভিটে বাড়ি বিক্রি করে যাননি।

বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে জেলে পল্লীর এই পরিবারগুলো সুখ-দুঃখের কথা কখনো কোনো নীতি নির্ধারণী সভা সমাবেশে আলোচিত হবে না। কিন্তু আমরা যারা নদী নিয়ে কথা বলি, পরিকল্পনা করি, নদীকে ভালোবাসি তাদের কাছে অনুরোধ, একবার এই বর্ষার সময় করে ঘুরে আসুন বছিলার জেলে পল্লী থেকে। নদীকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকা এই মানুষগুলোর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পাবেন। ভালোবাসতে পারবেন নদীকে, লড়তে পারবেন নদীর জন্য আরো শক্ত করে।