সোয়া এক কোটি লোকসংখ্যা ঢাকা শহরের কত ভাগ লোকের কমসংস্থান হয় ঢাকার
চারপাশের নদীগুলোর দ্বারা| কিংবা কি পরিমাণ লোক এখনো প্রত্যক্ষ পরোক্ষ ভাবে
তাদের কমসংস্থানের জন্য এই নদীর উপর নিভরশীল | তার কোন সংখ্যা আমার জানা
নেই। তবে একজন জামাই মাঝির (স্থানীয় মানুষজন তাকে এই নামে ডাকে) গল্প শুনাব
। জামাই মাঝির আসল নাম আলেখ, বাড়ি বরিশাল, ৪৫ বছর আগে একবার বনের জামাইয়ের
সাথে বছিলায় আসে। তারপর আর ফিরে যাওয়া হয়নি বরিশাল। এই বছিলাতে ঘর বাধে।
এলাকায় তাই সবাই তাকে জামাই বলে ডাকে। ছোট বড় সবার মুখে তার নাম জামাই। কেউ
বলে জামাই মাঝি।
আমাদের কোন পরিসংখ্যান, তথ্য কিংবা নীতি
নিধারনীর কাগজের হিসেবে যে জামাই মাঝির জীবন জীবিকার তথ্য নেই তা সত্য। বয়স
প্রায় ষাট্ট, পেশায় মাঝি। ৩৫ বছর এ পেশায়। এই জামাই মাঝির বুড়িগঙ্গা ছাড়া
আর কোন অবলম্বন নেই। কৈশরে খেলার ছলে নদীতে শখে বৈঠা হাত নেওয়া। যৌবনে এই
বৈঠাটার সাথে তার নাড়ী সম্পক হয়ে যায়। তারপর নৌকা, বৈঠা, নদী নেশা-পেশা।
আর বাধ্যকে এই বৈঠা ছাড়া তো তার কোন গতি নেই। বয়সের ভারে জীবন নিয়ে
ক্লান্ত হয়ে পড়া জামাই মাঝির যখন জীবন-জীবিকা নিয়ে কোন অবলম্বন নেই। তখনো
বুড়িগঙ্গাই তার একমাত্র অবলম্বন।
ইট,কাঠ আর রড-সিমেন্টের
উন্নয়ন বিদ্যার মাঝে জামাই মাঝিরা অবহেলিত। ৭০ উর্ধ্ব বুড়িগঙ্গা পাড়ের
মাঝিদের জন্য উন্নয়ন বিদ্যায় কিংবা পরিকল্পনায় যেন কোন স্থান নেই। রাষ্ট্র
তার পরিকল্পনায় শুধু উন্নয়নের দোহাই দিতে গিয়ে বিপন্ন করে দিচ্ছে হাজারো
জামাই মাঝিদের জীবন জীবিকা। প্রকৃতি আমার রাষ্ট্রের মত অবিবেচক নয়। আর তাই
তো বুড়িগঙ্গা বার্ধ্যকে জামাই মাঝিদের পেশার নিশ্চয়তা দিয়েছে। এই একপাড়
থেকে ওপার মানুষ পারাপার করাই জামাই মাঝিদের পেশা।
বছিলার জামাই মাঝির গল্প
মাথার
উপরে বিশাল বিজ্র হয়ে গেল তারপরও মানুষ নৌকায় পার হয় নদী জামাই? নাহ তেমন
একটা পরাপার হয় না। মাঝে মাঝে দিন কয়েকের মধ্যেও একজন পাই না। কিন্তু কি
করমু আমি তো আর কোন কাজ জানি না। আর এই বয়সে কে দিব কাজ? টাকা পয়সাও নাই যে
অন্যকোন ব্যবসা করমু। তাই নদীতে আইসা বইসা থাকি যদি কোন ক্ষ্যাপ পাই।
নাওয়ে (নৌকায়) শুইয়া থাকলেও শান্তি, খিদা লাগেনা, ফ্যান লাগেনা, শুধুই ঘুমে
আইয়ে (আসে)।
বিজ্র হওয়ার সময় আমরা সরকারের কাছে দাবী করেছি।
আমাদের একটা কাজের ব্যবস্থা করতে। সরকার আমাদের আপন ভাবে না। বয়স ৬০
কিন্তু কোন বয়স্ক ভাতা পাই না। সরকার ফালাই দিলেও নদী ফালাইতে পারে নাই।
বুইড়া আমারে এখনও মাঝি বানাইয়া রাখছে তার বুকে। হয়ত নদীর মধ্যেই মরমু।
আমি
আমাদের আসার কারণ জানালাম জামাইকে, নদীতে নাকি কুমির পড়েছে (এসেছে)? হুম
শুনছি কিন্তু দেখি নাই। কয়েকদিন যাবত দেখা গেছে মানুষে কয়। কিন্তু আমি দেখি
নাই।
শুশুকের অবস্থা কি? গেল কয়েক বছরের তুলনায় শিশু মাছ
(শুশুক) কমে গেছে, কমে গেছে গুইসাপ, মাছের পরিমাণ এখন শূণ্যের কোঠায়। তবে
বৃষ্টি নামলে মাছ ভাসব। আষাঢ়ের শেষ হইলে জাললারা আসা শুরু করবে। জামাই এখনো
বৈশাখ-জৈষ্ঠ,আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের হিসাব মনে রাখেন? হুম রাখতে হয়। আমি তো
নদীর মধ্যে থাকি আমাগো আষাঢ়-শ্রাবণের হিসাব রাখা আমাগো জন্য সহজ। নদীর পানি
দেইখ্যা আমরা বাংলা মাস কইতে পারি।
নদীটা সরকার না বেচলেও
পারত। জামাই নদী বেচল কে? সরকার নদী বেইচা দিচ্ছে। এই নদীতে এখন নামলেই
টাকা দিতে হয়। কারে টাকা দিতে হয় জামাই সরকারের লোক আছে। তারা নৌকা নিয়া
ঘুরে। আমরা কয়েকটা বুইড়া এইখানে এখনো নৌকা বাই। আমাগো আর কোন কাজ নাই। তাই
আমাগোরে দয়া কইরা তারা টাকা নেয় না। কিন্তু তাছাড়া আর কারো মুক্তি নাই। এই
নদীতে পদে পদে টাকা দিতে হয়।
জামাই কত মাঝি আছে এই গ্রামে ?
২০০মাঝি ছিল, এই বিজ্রটা আমাগো শেষ কইরা দিল। এখন ১০-১২জন বুইড়া বইসা থাকি এই পাড় আর ঐ পাড়ে। আমাদের নদীটাই সম্বল।
আমাদের
বুড়িগঙ্গা নিয়ে হাজার প্রকল্প। কোটি টাকার ছড়াছড়ি কিন্তু কোন প্রকল্পে
জামাই, আক্কাস আলী, মোসেদ মাঝিদের কথা লেখা থাকে না। তাদের বার্ধ্যকের এই
নদীটা যে এখনও তাদের একমাত্র জীবন জীবিকার অবলম্বন । তাও আমরা স্বীকার
করতে চাই না। আমরা স্বীকার করতে চাই না এই মাঝিগুলো আমাদের মানুষ। জীবনের
আর কিছুদিন পর আমাদেরও তাদের মত বয়স হবে। রাষ্ট্রে পরিকল্পনায় যদি আমরা এই
বয়স্ক মানুষগুলোকে স্থান দিতে না পারি। তবে সংকটপন্ন হবে আপনার আমার
ভবিষ্যৎও। বুড়িগঙ্গার মত বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া মানুষগুলোকে সমাজ ও রাষ্ট্র
ব্যবস্থায় নিরাপদ স্থান করে দিতে হবে |
জামাই মাঝির
গল্প শেষ। আমরা ঘোলা বুড়িগঙ্গার পানিতে শিকার খুঁজছি ক্যামেরা হাতে। আমাদের
সাথে এক নদী পাগলা। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই আমাদের তুলে দেওয়া হল আমাদের
জন্য নিধারিত ভাসমান অবস্থান কেন্দ্রে। এবার আমাদের যাত্রা শুরু...
ক্যামেরা রেডি ওয়ান,টু,থ্রি একশান। এই ক্যামেরা একশনের অন্য গল্প। এক নদী
পালগ মানুষের গল্প।
প্রিয় সবুজ সৈনিকরা আগামী পর্বে সেই বুড়িগঙ্গা নদী পাগলার গল্প শুনাব আপনাদের।
শহুরে যান্ত্রিক জীবন প্রায়ই বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ি। সত্য বলতে প্রতি মুহূতেই সুযোগ খুঁজি শহর থেকে পালাতে। কিছু করতে চাই । তাই ইচ্ছার বিরুদ্ধে রোবোটিক জীবন যাপন করতে হয় এ শহরে । জীবনের শুরুটা আমার ছোট এক শহরে। প্রাণবন্ত শহর ছেড়ে নিতান্ত বাধ্য হয়েই এই শহুরে জীবনের স্বাদ নিতে আসি। সত্যিই আবার ফিরে যাব আমার শহরে। আমি গুছিয়ে আমার ক্লান্তির কথা কাউকে বলতে পারি না, বলতে পারি না আমার স্বপ্ন কিংবা হতাশার কথা। তারপরও চেষ্টা করলাম " এই যান্ত্রিক শহর থেকে নিজেকে মুক্তির দেওয়ার পথটা জানানোর।
Showing posts with label বুড়িগঙ্গা নদী. Show all posts
Showing posts with label বুড়িগঙ্গা নদী. Show all posts
Friday, July 11, 2014
Subscribe to:
Posts (Atom)