এটা সময় ছিল ঈদ মানে আমার বাবার জন্য অপেক্ষা করা। সব বন্ধুদের মাঝে
আমার বাবাই ঢাকা থাকতেন। পুরো পরিবার আমরা অপেক্ষায় থাকতাম বাবা আসবে।
বাবা বাড়িতে আসার উপর নির্ভর করত আমাদের ঈদ আর ঈদের নতুন কাপড়। আর তাই বাবার বাড়িতে আসাটাই ছিল আমাদের ঈদ।র্
প্রতিবারই
বাবা বড্ড দেরি করে আসতেন। কখনো আসতেন গভীর রাতে, কখনো ঈদের দিন ভোরে।
এমনও হয়েছে সারারাত অপেক্ষা করে আমি নতুন কাপড়ের জন্য কান্নাকাটি করে
ঘুমিয়ে পড়েছি। কোন উপায় না দেখে রাতেই মা গত ঈদের পাঞ্জাবি ইস্ত্রি করে
রেখেছেন। যেন সকালে ঐ পাঞ্জাবি পড়ে নামাজ পড়তে যেতে পারি।
বাসা
থেকে কয়েকশ গজ দূরে আমার স্কুল ছিল। স্কুলের তিনতলার ছাদ থেকে রেলগাড়ির
আসা যাওয়া দেখা যেত। আমার ছাদের ওঠা নিয়ে ভয়ানক ভয় কাজ করত।
আমি কখনেই ছাদে ওঠতাম না। কিন্তু ঈদের দুই তিন আগ থেকে প্রতিদিন আমি বিকেলে আমার সকল ভয়কে জয় করে ছাদে উঠতাম আর রেল গাড়ি দেখতাম।
গোধূলি
নামের একটা ট্রেন ছিল। ঠিক গোধূলি বেলায় ট্রেনটা আমার শহরে এসে থামতো। ঐ
ট্রেনটা ঘিরে শুধু আমার না । পুরো এলাকার অনেকেরই উৎকন্ঠা থাকত।
ঢাকা
থেকে ঈদের কয়েকদিন আগ থেকে প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসত ঐ ট্রেনটা চেপে।
ট্রেনটা আসলে আমরা সবাই ছাদ থেকে নেমে বড় রাস্তায় গিয়ে অপেক্ষা করতাম
ঢাকা থেকে আসা অতিথিদের জন্য।
অতিথিদের রিকসার পিছনে
পিছনে একেবারে বাড়ি পযন্ত পৌছে দিয়ে আসতাম। আমার বাবার কখনো ঈদের আগে ঐ
ট্রেনে এসেছিলেন বলে মনে করতে পারছি না। কিন্তু আমি প্রতিবারই অন্যবন্ধুদের
সাথে বড় রাস্তায় অপেক্ষা করেছি বাবার জন্য।
বাবা হয়ত বড্ড ব্যস্ত ছিলেন কিংবা এত বড় একটা সংসারের প্রয়োজনীয় ঈদের সকল সামগ্রীসহ আসাটা তার কঠিন হয়ে পড়ত।
বাবার সেই কষ্ট, সামর্থ্য বুঝার কখনোই চেষ্টা করিনি ।
বরং
বড্ড রাগ হত বাবার উপর। কত প্রশ্নই না করেছি মাকে। সারাদেশের মানুষ ঈদে
বাড়িতে আসে আমার বাবার কি কাজ? কত কাজ? কিসের এত ব্যস্ততা তার?
এমনও ঈদ এসেছে জীবনে সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, বাবা আমার জন্য নতুন প্যান্ট আর শার্ট নিয়ে হাজির।
গতরাতে
জমানো হাজারো রাগ, অভিমান, অভিযোগ, কান্না ভুলে পকেটে বাবার দেওয়া নতুন
চকচকে টাকা নিয়ে। বাবার হাত ধরে গিয়েছি নামাজ পড়তে। আসার সময় রঙ্গিন
বেলুন হাতে বাড়ি ফিরেছি।
এখনো শহরে গোধূলিবেলায় গোধূলি
নামের ট্রেনটা এসে থামে, সময়ের আগে জোড়ায় জোড়ায় নতুন কাপড় আসে আমার
জন্য। কাপড়ের জন্য আমার আর অপেক্ষা করতে হয় না। শুধু অপেক্ষা আমার বাবার
জন্য, আমার বাবা আসে না।
১৫টি ঈদ পার করলাম বাবাকে ছাড়া। ১৬ তম ঈদের প্রস্তুতি চলেছে।
চারিদিকে
নতুন কাপড়, চকচকে টাকা, রঙ্গিন বেলুনের সুবাস, গরু-খাসি কেনার প্রস্তুতি।
এই সকল প্রস্তুতির মাঝে বিশাল শূণ্যতা বাবাকে নিয়ে।
বাবা অসম্ভব মনে পড়ে, প্রচন্ড মনে পড়ে বাবা তোমাকে।
যতই রাত হোক, ভোর হোক, দেরি হোক, তুমি আসো বাবা।
আবারও আমাদের ঈদ হয়ে, আমার ঈদ হয়ে আসো তুমি।
শহুরে যান্ত্রিক জীবন প্রায়ই বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ি। সত্য বলতে প্রতি মুহূতেই সুযোগ খুঁজি শহর থেকে পালাতে। কিছু করতে চাই । তাই ইচ্ছার বিরুদ্ধে রোবোটিক জীবন যাপন করতে হয় এ শহরে । জীবনের শুরুটা আমার ছোট এক শহরে। প্রাণবন্ত শহর ছেড়ে নিতান্ত বাধ্য হয়েই এই শহুরে জীবনের স্বাদ নিতে আসি। সত্যিই আবার ফিরে যাব আমার শহরে। আমি গুছিয়ে আমার ক্লান্তির কথা কাউকে বলতে পারি না, বলতে পারি না আমার স্বপ্ন কিংবা হতাশার কথা। তারপরও চেষ্টা করলাম " এই যান্ত্রিক শহর থেকে নিজেকে মুক্তির দেওয়ার পথটা জানানোর।
Showing posts with label বাবা. Show all posts
Showing posts with label বাবা. Show all posts
Monday, March 21, 2011
Subscribe to:
Posts (Atom)