'বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই, কুড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই। আমি
থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে তুমি কত কষ্ট পাও রোদ বৃষ্টি ঝড়ে।
স্বাধীনতার সুখ নামক কবিতায় রজনীকান্ত সেন এর
চড়াইয়ে সুখের গল্প সবাই জানলেও। সুপরিচিত চড়াইয়ে নগর জীবনের সুখ শূন্যের কোটায় । বিশেষ
করে ঢাকার মত শহরগুলোতে চড়াই/চড়ুই দেখা পাওয়াই কঠিন।
যেকোন
লোকালয়ের আশেপাশে চড়ুই একটি সুপরিচিত পাখি। এরা জনবসতির মধ্যে থাকতে ভালোবাসে
তাই এদের ইংরাজি নাম হাউস স্প্যারো অর্থাৎ "গৃহস্থালির চড়াই/চড়ুই।
পৃথিবীতে
মোট ৪৮ প্রজাতির চড়ুই দেখতে পাওয়া যায়। জীববিজ্ঞান অনুযায়ী এদের
পরিবার ১১টি গণে বিভক্ত। "গৃহস্থালির
চড়ুই" এদের মধ্যে সবচেয়ে সুপরিচিত। এদের আদি নিবাস ছিল মূলত ইউরেশিয়া ও
আফ্রিকা মহাদেশ।
কয়েক দশ আগেও ঢাকা শহরে বাড়ির উঠান, ঘরের কোনে, বারান্দায় চড়ুইয়ের উপস্থিতি ছিল খুবই স্বাভাবিক। চড়ুইয়ের ডাকে
শুরু হত সকাল। আর সন্ধ্যায় চড়ুইয়ের ডাকে আমরা বুঝতাম মাঠ থেকে বাড়ি ফিরতে হবে।
ঘরের ভেন্টিলেটারে চড়াই দম্পতির সংসারটায় সদ্য জন্ম নেওয়া চড়াই আমাদের পরিবারের
অংশই ছিল। ভোর রাতে রোজার সময় প্রায়ই দেখতাম চড়াই এসে খাবার নিচ্ছে টেবিল থেকে।
মাঝে বারান্দায় রেখে যাওয়া চায়ের কাপে খুই উৎসাহ নিয়ে চড়াই ঠোট ভিজায়। এসব খুব
বেশিদিন আগের নয়। গেল দুই দশ আগের গল্প।
শহরটা ক্রমেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে চড়াইয়ের জন্য। স্বাধীনতার সুখ কবিতার বাবুই তো
শহর ছেড়ে পালিয়েছে বহু আগে। আর চড়াই গত কয়েক শতকে ইট কংক্রিটের নগর জীবনের
সাথে শহুরে জীবন যাত্রা মানিয়ে নিতে পারলেও। বতমানে নগরগুলো চড়াই শূন্য হয়ে পড়ছে। নগরগুলোতে
চড়াই কমে যাবার অন্যতম কারণ হল
মোবাইল অপারেটরদের টাওয়ারগুলো। যেখান
দিয়ে তরঙ্গ
প্রবাহিত করে সেই জায়গাগুলোই চড়াইদের উড়ার জন্য প্রকৃত উচ্চতা। ফলে তারা বেশীর ভাগ সময়ই সাবলীলায় উড়তে পারে
না, পথ
হারায়।
ইট কংক্রিটের
শহরে মানুষের তৃষ্ণনা মেটাতে নগর কতৃপক্ষে হাজার কোটি টাকা বাজেট থাকলেও কোথাও
চড়াইয়ের তৃষ্ণনা মেটাবার জলের ব্যবস্থা নেই। নগরে কোটি টাকা ব্যয়ে সৌন্দযবধনের
সারি সারি গাছ লাগনো হয় । কিন্তু ক্ষুদ্র চড়াইয়ে খাদ্যের জোগান দিবে তেমন গাছ নেই।
সব মিলিয়ে নগরগুলো চড়াই বান্ধব নয়।
আমাদের এই পরিবেশ বিধ্বংসী উন্নয়নের কারনে হয়ত একদিন নগর থেকে চড়াই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু বিলুপ্ত শুধু চড়াইয়ের মত ক্ষুদ্র পাখিটির বিলুপ্ত হওয়া নয়। চড়াইয়ের বিলুপ্তি নগরগুলো যে ক্রমেই মনুষ্য বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে তারই প্রমান।
এত হতাশার
মাঝে ঢাকা শহরে কিছু কিছু স্থানে আমি সুখ নিয়ে চড়াই দেখি। সন্ধ্যায় কিচির মিচির
শব্দে কানে তালা লাগার মত অবস্থা। আমি অস্থির চোখে তাকিয়ে দেখি চড়াই দম্পতির
ব্যস্ততা। তারপর সন্ধ্যার আলো নেভার আগেই চড়াইগুলো কোথায় যেন মিলিয়ে যায়।
তবে কিছু
কিছু এলাকায় ভিন্ন আচরনের চড়াই দেখি। দেখি সারারাত শত শত চড়াই দম্পতি গাছে ডালে
বসে থাকে। তাদের কোন ঘর নেই। পাশে বড় বড় অট্টালিকা থাকলে শত শত চড়াইয়ে কেউ সেই
অট্টালিকাগুলোতে যায় না। মোহাম্মদপুর বেড়িবাধ এলাকার সাদেক খান ফিলিং স্টেশনে
বাগান বিলাশ গাছের ঝোপে আমি এমন কয়েকশ চড়াই দেখেছি। দিনের পর দিন সারা রাত জেগে
থেকে লক্ষ্য করেছি পাখিগুলো রাতে কোথাও যায় কিনা। ভোর হবার আগ পযন্ত ওরা ওখানে বসে
থাকে। তেল পাম্পের কতৃপক্ষ চড়াইয়ের জন্য খাবার পানি ও খাদ্যের বিশেষ ব্যবস্থা করেছে।
রজনীকান্ত সেন এর
স্বাধীনতার সুখ নামক কবিতা আর আমাদের ভেন্টিলেটারে থাকা চড়াই দম্পতি দেখে
বুঝতে শিখে ছিলাম চড়াইরা অট্টালিকায় আশ্রয় নেয়। কিন্তু সাদেক খান পাম্পের নগরের
এই চড়াইগুলো দেখি ভিন্ন কিছু।
তারা সারারাত গাছেই থাকে।
হয়তবা প্রতিকূল পরিবেশ বেঁচে থাকার জন্য ভিন্ন কোন কৌশল রপ্ত করছে।
কৌশল যাই হোক
চড়াইগুলোকে বাঁচতে দিতে হবে। আমাদেরও কৌশলী হতে হবে। আমাদের চারপাশের পরিবেশ
চড়াইবান্ধব করতে হবে। যে শহরে এই ছোট প্রাণী চড়াই নিরাপদ নয় সেই শহরে আমরা এত বড়
প্রাণী আর কতটাই নিরাপদ থাকবে। বিলুপ্ত হওয়া চড়াই রক্ষার স্বার্থে একদল লোক ২০১০
সাল থেকে ২০
মার্চ পালন করছে চড়ুই দিবসবা World Sparrow Day।
শুধুই নগরে চড়াই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়াই সমস্যা নয়।
সমস্যা হল এই শহরে চড়াই বিলুপ্ত হওয়াটা আমি দেখছি মানুষ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার
পদধ্বনি হিসেবে।
No comments:
Post a Comment