জীবন বলতে আপনি আর আমি কি বুঝি তার অর্থে এই দুই মানুষের জীবন ভিন্ন কিছুই হবে। কিন্তু আমাদের কাছে জীবনের অর্থ যাই হোক। ওরা জীবন উপভোগ করছে। তাদের সেই অধিকারও আছে। আমার আপনার অতিকৌতুহল যেন তাদের জীবনের ব্যাঘাত না ঘটায়।
২০১১ সালের এক সকালে ঢাকা থেকে উপকূল ট্রেনে রওনা দিলাম “জীবন” দেখতে যাব
বলে। ট্রেন থেকে নেমে আমাদের জন্য নিধারিত সিএনজি চালিত টেম্পুতে চড় বসলাম।
মিনিট ত্রিশ চলার পর টেম্পুটি একটি নদীর তীরে এসে দাড়াল। এবার যাতায়াতের
মাধ্যম পরিবতন করতে হবে। আমরা ছোট একটি নৌকায় উঠে বসলাম। মাঝিসহ আমরা চারজন
এত ছোট তিতাসকে দেখেছি আজ তার পুরোপুরি বিপরতী। বিশাল বিশাল ঢেউ। ছোট
নৌকাটা যেন বার বারই উল্টে যেতে চায়। মাঝির দক্ষতার সাথে আমাদের একটা
পরিত্যাক্ত ইটের ভাটায় নামিয়ে দিয়ে গেল। এটাই আমাদের প্রাথমিক গন্তব্য।
চারিদিকে
নদী আর মাঝখানে ইটের ভাটা। কেমন যেন ভূতুরে পরিবেশ। আগামী দুইদিন এখানে
থাকতে হবে। একটা অস্থায়ী ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হল। নদীর জলে হাত
মুখ ধুয়েই আলী ভাত ( স্থানীয় ভাবে সারা বছরে উৎপাদিত সকল শ্রেনীর শষ্যের
বীজ দিয়ে রান্না ভাত)খেয়ে। কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে ঘুমাতে গেলাম। দুপুরে ঘুম
থেকে উঠার পর জানানো হল খাবারের জন্য আমাদের নদীর মাঝখানে যে সবুজ একটা চল
দেখা যায় সেখানে যেতে হবে। ঐটাই তাদের আসল বসত ভিটা। আবারও সঙ্গী সেই ছোট
নৌকা। ডুবুডুবু করে আমরা গন্তব্যে মিনিট দশেকের মধ্যে আমরা গ্রামে পৌছলাম।
ছোট গ্রাম দশটি পরিবাররও হবে এই গ্রামের। বষায় নৌকা আর শুষ্ক মৌসুমে হাটা।
এই দুই ছাড়া ঐ গ্রামের কোন যাতায়াত মাধ্যম নেই। আমাদের জন্য খাবারের আয়োজন
করা হয়েছে। পুঁইশাক, লেবু পাতা দিয়ে টাকি মাছ, চান্দা মাছ ভাজি, ছোট ছোট
আলু ভাতি চিংড়ি শুটকি দিয়ে, মিষ্টি আলুর টক আর লাল বোরো চালের ভাত।
ভাত
খেয়ে গ্রাম দেখার পালা। কয়েক লক্ষ বগ ফুটের মধ্যে সবার জীবন বাধা। চাইলেও
যেন বেশি কিছু করা নেই। কিছু সময় হাটাহাটি করার পর আমরা অনুমতি চাইলাম
রাতটা গ্রামে কাটানোর জন্য। আমাদের থাকার অনুমতি মিলল। সন্ধ্যা সতটার আগে
ডাক পড়ল খাবারের জন্য। এত তাড়াতাড়ি খেতে পারব কি করে? লোকজন আটার মাঝে তারা
ঘুমিয়ে পড়বে। কাল সকাল থেকে শুরু হবে কাজ। দশটা পযন্ত জেগে থেকে ঘুমাতে
গেলাম। কোন ভাবেই ঘুম আসে না। গর্জনে নদী যেন সমুদ্রকে মাঝে মাঝে হার
মানায়। এখানে নদীর ঢেউয়ে শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।
ভোরের আলো
আসার আগে আমাদের ডাক পড়ল। ক্যামেরা নিয়ে দুইজনই তাদের কাজ শুরু করল। আমার
কোন কাজ নেই। আমি শুধু দেখছি একটা মেয়ে সারা দিনে কত কাজ করে। তারা পালা
করে ছবি তুলছে প্রতিটি কাজের ছবি। সন্ধ্যার সাথে সাথে মনে হল মেয়েটা শতাধিক
কাজ করে। রাতে খাবারের পর আমাদের সাথে এসে বসলেন তিনি। জীবনের প্রতিটি
ক্ষেত্রে মেধার সর্বোচ্চ পরিচয় দিয়ে এই গ্রামে এসে ভিত্তি গেড়েছেন তিনি। অথ
একটাই “জীবন” তিনি জীবন উপভোগ করতে চান। আর তা প্রকৃতির সাথে মিলে মিশে।
কিভাবে চলে এই জীবন সৌর বিদ্যুতের সাহায্যে আলোর কৃত্রিম ঝলক আসে সত্যি।
কিন্তু তাছাড়া সকল কাজই সেরে ফেলি সূর্যের আলোয়। সপ্তাহে একদিন শহরে যাই
প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতে। পড়াশোনার বই আনতে মাঝে মাঝে ঢাকায় যাই দুজনে, আর
বেশির ভাগ বই আসে দেশের বাইরে থেকে ডাকে। অনলাইনে পড়াশোনার তেমন অভ্যাস না
থাকায় তিনি সকল বই-ই প্রিন্ট দিয়ে পড়েন। বই গুলো নিজেই বাধাই করেন। পাশের
গ্রামের সরকারী স্কুলে সপ্তাহে দুইদিন শিশুদের ইংরেজি আর গণিত পড়ান।
পরেদিন
সকালে আমরা তার স্বামীর কাজ দেখেতে ব্যস্ত হলাম। সকাল থেকে তাকে অনুসরণ।
তার সাথে বাজারে গেলাম। বেচারার অনুরুধ একটা কোনভাবেই যেন মানুষ বুঝতে না
পারে বিশেষ ভাবে তার ছবি তোলা হচ্ছে। দুইজনই তার মতামতকে শ্রদ্ধা জানিয়ে
ছবি তোলে। ২০১১ সালের এই ছবি তোলার কাযক্রম ২০১৫ সাল পযন্ত চলবে। এই সময়ের
মধ্যে তাহাদের কোন প্রকার ছবি, কিংবা গ্রামের ছবি প্রকাশে আমার নৈতিক বাধা
হয়েছে। তবে অনুমতিক্রমে ততটুকু তথ্য প্রদানে বাধা নেই যা তাদের স্বাভাবিক
জীবন যাপনের জন্য অন্তরায় নয়।
২০১১ সাল এবং ২০১২ পযন্ত আমার মোট ৫বার তাদের সাথে দেখা হয়েছে। এবং
২০১২ শাহবাগে একদিন জিজ্ঞাসা করলাম কেন গণমাধ্যমে এড়িয়ে চলেন?
তিনি
জানালেন, একবার একজন তার একজন সংবাদ প্রকাশ “ প্রেমের তরী ভিড়ল
.....গ্রামে” শীষক সংবাদটিতে তাদের অনেক অসত্য ব্যক্তিগত তথ্য প্রদান করা
হয়েছে। এবং কিছু সত্য তথ্য ও দেওয়া হয়েছে যা একান্ত ব্যক্তিগত। ঐ সংবাদের
পর পর মানুষজন নিয়মিত তাদের গ্রামে যায় এবং তার সাথে ছবি তুলে। ক্লাস চলা
সময় ক্লাসের ভিতর চলে যায়। তার স্বামী বাজারে গেলে বাজারে তার ছবি তুলে।
ক্রমেই তারা চিড়িয়াখানার জন্তুতে পরিণত হয়ে যাচ্ছিল।
কেন শহরের জীবন বাদ দিয়ে এই জীবনের পথে?
জীবন
মানে জীবন। জীবন মানে ভালবাসা। জীবন মানে প্রকৃতির কাছাকাছি বসবাস। আমার
কাছে জীবন মানে প্রতি মূহুর্তে অন্য জীবনের সাথে ল্যাপটে চ্যাপটা হয়ে
যাওয়া। এই সবই আমি পাই এই গ্রামে। তাই শহুরে জীবন কিংবা গ্রামীণ জীবন নয়।
আমি জীবনের জন্য বাঁচার স্বাদ পেতে এই গ্রামের আছি। তাছাড়া আমার স্বামীর
পূব পুরুষরা এই গ্রামে কাটিয়েছে তাদের জীবন।
কেমন উপভোগ করছেন জীবন?
খুব
খারাপ নেই, আপনারা খাবার আর বিলাসীকতার জন্য দৌড় জাপ করছেন। আর আমরা এখানে
তাই উপভোগ করছি। শুধু পাথ্যক আপনার সব কিনে আনেন। আমরা এখানে উৎপাদন করি ।
আমাদের প্রতিটি খাবারে আমরা আমাদের শ্রমের গন্ধ পাই।
গ্রামের মানুষদের যেতে দিতে আপনাদের এত আপত্তি কেন?
আমার
সকল কিছু আপনাকে জানাতে হবে তা তো কোথাও নিয়ম নেই। আপনারা গ্রামে আসুন
আমাদের আপত্তি নেই। তবে কতজন আসতে পারবেন, কতজন আসবেন, কখন আসবেন, তা আমরা
নির্ধারণ করব। আমাদের এই গ্রাম কোন ট্যুরিস্টদের জায়াগা নয়। তাছাড়া আপনি কি
দিবেন আপনার গুলশান, ধানমন্ডি কিংবা বারিধারা বাড়িতে আমাদের অবাধ বিচরণ
করতে। তাছাড়া কাউকে থাকার কোন প্রকার অনুমতি দেওয়া হবে না।
জার্মান
ভাষায় একটি ব্লগ এবং বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় ব্লগে এই পরিবারটি সম্পর্কে
লেখায় তাদের গ্রামে দশনাথীদের সংখ্যা বেড়ে যায়। যা তাদের স্বাভাবিক জীবন
যাত্রায় প্রভাব ফেলে। ফলাফল তারা সকল প্রকার গণমাধ্যম এবং অনাকাঙ্খিত
ব্যক্তির উপস্থিতি এড়িয়ে চলেন। গ্রামটির নাম ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনে সভ্য
মানুষদের অসভ্য আচরনের প্রভাবে স্বাভাবিক জীবন যাপনে সমস্যা হয় বিধায়
গ্রামের নাম দেওয়া হয়নি।